অব উপনিবেশীকরণ: সংজ্ঞা, কারণ ও ইতিহাস

অব উপনিবেশীকরণ

অব উপনিবেশকরণ (Decolonisation) এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে উপনিবেশগুলো উপনিবেশ শক্তি থেকে স্বাধীন হয়। অর্থাৎ অব উপনিবেশকরণ প্রক্রিয়া বলতে বোঝায়, যার মাধ্যমে উপনিবেশগুলো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় সাম্রাজ্যবাদী বা উপনিবেশবাদী শাসনের অবসান ঘটে এবং বিভিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে, এই প্রক্রিয়াকে অব-উপনিবেশীকরণ (Decolonisation) হিসেবে অভিহিত করা হয়।

অব উপনিবেশীকরণ: সংজ্ঞা, কারণ ও ইতিহাস, azhar bd academy

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাত্বক পরিণতির পর, ইউরোপীয় দেশগুলো ক্রমশই অর্থনৈতিক ও সামরিক দুর্বল হয়ে যায়। সাধারণত দূরবর্তী বা উপনিবেশগুলোর বিদ্রোহ দমন করার জন্য তাদের প্রয়োজনীয় সম্পদ এবং রাজনৈতিক সমর্থন ছিল না। এছাড়া তারা নতুন পরাশক্তি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিল, যারা ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর, কোরিয়া ঔপনিবেশিক শাসন থেকে সর্বপ্রথম মুক্তি লাভ করে।

অ-উপনিবেশীকরণ প্রক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৬ সালে ফিলিপাইন ত্যাগ করে। ব্রিটেন ১৯৪৭ সালে ভারত, ১৯৪৮ সালে প্যালেস্টাইন এবং ১৯৫৬ সালে মিশর ছেড়ে যায়। এই প্রক্রিয়ায় ব্রিটেন ১৯৫০-৬০ এর দশকে আফ্রিকা থেকে, ১৯৭০-৮০ এর দশকে বিভিন্ন সংরক্ষিত দ্বীপ অঞ্চল থেকে এবং ১৯৯৭ সালে হংকং থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে। ফরাসিরা ১৯৫৪ সালে ভিয়েতনাম ত্যাগ করে এবং ১৯৬২ সালের মধ্যে উত্তর আফ্রিকান উপনিবেশগুলো ছেড়ে দেয়। পর্তুগাল ১৯৭০ সালে আফ্রিকান উপনিবেশগুলো ছেড়ে দেয় এবং ১৯৯৯ সালে ম্যাকাও চীনাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়।

অব উপনিবেশীকরণ প্রক্রিয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ, রাজনীতি, ধর্মীয় ও জাতিগত আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক চাপ। বিশেষ করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে উত্তর আফ্রিকা এবং ভারতের মতো অনেক অঞ্চলে স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে আসে। এই সুযোগে তারা ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করতে থাকে। অবশেষে, অনেক দেশ উপনিবেশবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করতে এবং নতুন স্বাধীন জাতি গঠন করতে চেয়েছিল যা আনুষ্ঠানিক সাম্রাজ্যের অবসান ঘটায়।

অব উপনিবেশকরণের কারণ

অব উপনিবেশীকরণ প্রক্রিয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ, রাজনীতি, ধর্মীয় ও জাতিগত আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক চাপ। অ-উপনিবেশকরণের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
  • বিশ্বযুদ্ধ (১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধ)
  • ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর অর্থনৈতিক দুর্বলতা ও সামরিক সংকট
  • আন্তর্জাতিক চাপ
  • ঔপনিবেশিক স্বাধীনতা আন্দোলন
  • জাতিসংঘের অব উপনিবেশকরণ প্রক্রিয়া
  • জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্ভব
  • সাম্রাজ্যবাদের বিলুপ্তি
  • দুই পরাশক্তির আবির্ভাব
  • বিশ্বায়ন
  • সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো দেওলিয়া হওয়া
  • কমিউনিজমের উত্থান
  • তৃতীয় বিশ্বের উত্থান
  • আমেরিকার বৈদেশিক নীতির প্রভাব

ইতিহাস

১৯ শতক জুড়ে, ইউরোপে অব উপনিবেশকরণ শুরু হয় যেখানে অটোমান সাম্রাজ্য (তুরস্ক) দুর্বল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে রুশ-তুর্কি যুদ্ধের (1877-1878) পর, এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি রাজ্য স্বাধীনতা লাভ করে: যেমন বুলগেরিয়া, গ্রীস, মন্টিনিগ্রো, রোমানিয়া, এবং সার্বিয়া।

ল্যাটিন আমেরিকায়, স্প্যানিশ-আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় (1808-1833), অনেক দেশ স্পেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, যার মধ্যে রয়েছে: বলিভিয়া, কোস্টারিকা, এল সালভাদর, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, মেক্সিকো, নিকারাগুয়া, এবং ভেনেজুয়েলা।

২০ শতকের প্রথম দিকে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান এবং রাশিয়ান সাম্রাজ্যের সাথে অটোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটায়। এই নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং অন্যান্য নতুন দেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ যেমন ইরাক এবং সৌদি আরব স্বাধীনতা লাভ করেছিল। কিন্তু অন্যান্য দেশ, যেমন সিরিয়া, লেবানন এবং প্যালেস্টাইন ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ফরাসি এবং ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে ছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে প্যারিস শান্তি সম্মেলনে (1919-1920) লিগ অফ নেশনস নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা তৈরি করা হয়েছিল। লীগের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এই সংস্থাটি একটি ম্যান্ডেট সিস্টেম তৈরি করেছিল যা ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি যেমন ব্রিটেন এবং ফ্রান্সকে মধ্যপ্রাচ্যে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রাক্তন অঞ্চলগুলোর উপর আংশিক নিয়ন্ত্রণ-ম্যান্ডেট দেয়। ফলস্বরূপ, সিরিয়া ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত ফরাসি ম্যান্ডেটের অধীনে ছিল এবং ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত প্যালেস্টাইন ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের মতো ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যগুলো দুর্বল হয়ে যায়। সেইসাথে ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ অব উপনিবেশকরণ প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করে।

Do not enter any harmful link

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Do not enter any harmful link

Post a Comment (0)

নবীনতর পূর্বতন