স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের পার্থক্য

স্বাধীনতা ও মুক্তি শব্দ দুটি আসলে এক নয়। দুটি ভিন্ন অর্থবোধক শব্দ। স্বাধীনতা সংগ্রাম হল দেশকে স্বাধীন করার সংগ্রাম। এটি মূলত রাজনৈতিক স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত, কিন্তু মুক্তি সংগ্রাম বলতে একটি ব্যাপক ও বিস্তর ধারনাকে বুঝায়, যেমন: অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক মুক্তি, এবং সাংস্কৃতিক মুক্তি ইত্যাদি।

স্বাধীনতা প্রথম পদক্ষেপ, মুক্তি চূড়ান্ত লক্ষ্য। তাই, সংগ্রাম ছিল মুক্তির। মুক্তির জন্য সংগ্রামটা দীর্ঘকালের। এ লড়াইয়ে নানা মানুষ এসেছে, নান সংগঠন এসে যোগ দিয়েছে। সবার ভূমিকা সমান নয়। নানা মাত্রার ও মাপের। কিন্তু সব স্রোত মিলেই বৃহৎ ধারাটি তৈরি।নিম্মে স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের পার্থক্য আলোচনা করা হলো।

স্বাধীনতা যুদ্ধ কি?

স্বাধীনতা যুদ্ধ (Independence war) হল দেশকে স্বাধীন করার সংগ্রাম। এটি মূলত রাজনৈতিক স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত। স্বাধীনতা যুদ্ধ দানা বাঁধে মুক্তির আকাঙ্ক্ষার থেকে এবং তা কিছু কাল বা কয়েক বছর চলতে পারে।

স্বাধীনতার জন্য অনেক দেশই যুদ্ধ/সংগ্রাম করেছে। এর পেছনের কারণগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক। যেমন- ১৭৭৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ টি ব্রিটিশ উপনিবেশিক রাজ্য স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ করে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।


মুক্তিযুদ্ধ কি?

মুক্তিযুদ্ধ (Liberation war) বা মুক্তির জন্য সংগ্রাম বলতে একটি ব্যাপক ও বিস্তর ধারণাকে বুঝায়। যেমন: অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক মুক্তি, এবং সাংস্কৃতিক মুক্তি ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধ একটি জাতির জীবনের লাগাতার প্রক্রিয়া, যা নিরন্তর চেতনাজগতকে আলোড়িত করে মুক্তি সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করে।

মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে একটি জাতি বা গোষ্ঠীর মুক্তি বা স্বাধীনতা লাভের জন্য লড়াই। এই লড়াই সংগঠিত হতে পারে একটি ঔপনিবেশিক শক্তিকে উৎখাত করার জন্য অথবা কোন স্বৈরশাসক বা একনায়ককে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের জন্য।



স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ কী?, azhar bd academy

একাত্তরের যুদ্ধটি স্বাধীনতার নাকি মুক্তির?

একাত্তরের যুদ্ধ মুক্তির ছিল, নাকি স্বাধীনতার? উভয়েরই। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন মাত্র একবার কিন্তু মুক্তি শব্দটি উচ্চারণ করেছেন অনেকবার। ৭ মার্চের সেই বিখ্যাত জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান উভয়ের কথাই বলেছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’’।


তিনি আরো বলেছেন, ‘দেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি’ চায়। সে জন্য সংগ্রাম করতে হবে এবং যতক্ষণ ‘দেশের মুক্তি না হচ্ছে’, ততক্ষণ সংগ্রাম চলবে। 
এছাড়াও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে’ বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ।

কিন্তু যুদ্ধের সময়  এবং যুদ্ধের পরে এই দু‘য়ের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয়নি। কিন্তু পার্থক্য নিশ্চয়ই ছিল। না হলে, পরে জিয়াউর রহমানের শাসনে সংবিধানে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তাতে ‘মুক্তি’ সরিয়ে সে জায়গায় ‘স্বাধীনতা’ বসানো হল কেন? কেন প্রয়োজন পড়ল এই সংশোধনের?

আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে, এক নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করিয়াছি।’’

১৯৭৮-এ জারি করা এক ফরমানের বলে সংবিধানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। তারমধ্যে অন্যতম ছিল, প্রথম অনুচ্ছেদের ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’- এই কথাটির স্থলে হয়েছে ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ।’ এরপরে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে যেখানে অঙ্গীকারের কথা আছে সেখানেও ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ কেটে বসানো হয়েছে ‘জাতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ’। মুক্তি অনেক ব্যাপক ও গভীর ব্যাপার। স্বাধীনতা বলতে রাজনৈতিক স্বাধীনতা বোঝান সম্ভব, কিন্তু মুক্তি বলতে বোঝাবে সার্বিক মুক্তি( যেমন: অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ও সাংস্কৃতিক ইত্যাদি)।


হ্যাঁ, স্বাধীনতার জন্য লড়াই হয়েছিল ১৯৭১ সালে। পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালিরা চেয়েছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্রের অধীনতা থেকে বের হয়ে এসে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু সেটা একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। অথবা বলা যায়, মূল লক্ষ্য ছিল অনেক বিস্তৃত। সেটা ছিল জনগণের মুক্তি।

এ দেশের মানুষ মুক্তির জন্য সংগ্রাম অনেক কাল ধরে করে এসেছে। প্রচার করা হয়েছিল যে, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা তাকে মুক্তি দেবে। কিন্তু তা দিল না। তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছরও পূর্ণ হয়নি, তার আগেই নতুন আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন। ওই দাবিতে ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ ঢাকায় ধর্মঘট হয়েছে। বায়ান্নতে রক্ত দিতে হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটা স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম। স্বতঃস্ফূর্ততার বহু গুণ ও সীমাবদ্ধতা তার মধ্যে পাওয়া যাবে। প্রধান গুণ হচ্ছে যুদ্ধের শক্তি ও বেগ; প্রধান দুর্বলতা তার সংগঠিত রূপ। যুদ্ধটা সংগঠিত, পরিকল্পিতভাবে শুরু হয়নি এবং চলেও নি।


বিপরীতে পাকিস্তানিরা ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত ও সুসজ্জিত। তাদের ছিল বিদেশি শক্তির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন মিত্র বলতে বাঙালির প্রায় কেউই ছিল না। ভারত যে যুক্ত হয়েছে তা আগের কোনো যোগাযোগের কারণে নয়, ঘটনা পরম্পরায়। একে সে প্রতিবেশী, তার ওপরে ছিল ১ কোটি শরণার্থীর বোঝা।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি কিন্তু কোনো কারণে যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হতাম তাহলে আমাদেরকে পরাধীন জাতিতে পরিনত করতো। তারপরও, আমাদের যুদ্ধটি শুধুমাত্র স্বাধীনতার যুদ্ধ নয় – এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ। উত্তর আমেরিকায় ১৭৭৫ থেকে ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্য ও তার তেরোটি উপনিবেশের মধ্যকার যুদ্ধটি স্বাধীনতার যুদ্ধ। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ হবার আবশ্যকীয় উপাদানগুলোর অনেকগুলোই সেখানে অনুপস্থিত।

পক্ষান্তরে আমাদের যুদ্ধটি পাকিস্তান রাষ্ট্রটির ধারণা দ্বিজাতি তত্ত্বের বিপক্ষে, ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠনের বিপক্ষে,  কাল্পনিক জাতিপরিচয় সৃষ্টির বিপক্ষে এবং জাতিগত শোষণের বিপক্ষে।


Do not enter any harmful link

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Do not enter any harmful link

Post a Comment (0)

নবীনতর পূর্বতন