জেনেভা কনভেনশন কি? চুক্তির প্রেক্ষাপট ও শর্তসমূহ

জেনেভা কনভেনশন কি?

জেনেভা কনভেনশন হচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বৈঠকের একটি সিরিজ যা বেশ কয়েকটি চুক্তি সম্পাদন করেছিল। বিশেষ করে সশস্ত্র সংঘাত বা যুদ্ধের সময় মানবিক আইন, আহত বা বন্দী সামরিক কর্মী, চিকিৎসা কর্মী এবং অ-সামরিক নাগরিকদের মানবিক চিকিৎসার জন্য বিধিবদ্ধ আন্তর্জাতিক আইন। 

জেনেভা কনভেনশনের প্রথম চুক্তিটি ১৮৬৪ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে সম্পাদিত হয়েছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, চতুর্থবারের মত ১৯৪৯ সালে উল্লেখযোগ্যভাবে এটি আপডেট করা হয়েছিল। বর্তমানে জেনেভা কনভেনশন বলতে বুঝায় এই চারটি সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের সম্মিলিত রূপকে।

জেনেভা কনভেনশন কি? চুক্তির প্রেক্ষাপট ও শর্তসমূহ, azhar bd academy

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদনক্রমে ১৯৫০ সাল থেকে জেনেভা কনভেনশন কার্যকর হয়। এ কনভেনশন পূর্ববর্তী তিনটি কনভেনশনের সংশোধিত রূপ। ২০০৬ সালের ২৭ জুন পর্যন্ত বিশ্বের ১৯৪টি দেশ জেনেভা কনভেনশন অনুমোদন করে। সর্বশেষ দেশ হিসেবে নাউরু এ কনভেনশন অনুমোদন করে।

জেনেভা কনভেনশনের প্রেক্ষাপট

১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত ফরাসি সেনানায়ক নেপোলিয়ানের বেলজিয়ামের ওয়াটার-লু যুদ্ধের পর থেকে, ইউরোপে ইতালির আধিপত্য বেড়ে যায়। ১৮৫৩-৫৬ খ্রিষ্টাব্দের অনুষ্ঠিত ক্রিমিয়ার যুদ্ধ, ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দের সলফেরিনো যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এ সকল যুদ্ধে হাজার হাজার সৈন্য নিহত হয় এবং কয়েক সহস্র সৈন্য আহত অবস্থায় মরণযন্ত্রণা ভোগ করে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে থাকে।

সুইজারল্যান্ডের প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী এবং স্যার হেনরি ডুনান্ট যুদ্ধাহত এবং বেসামরিক নাগরিকদের দুর্দশা দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘মানবজাতির ইতিহাসের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যুদ্ধের মৌলিক নিয়মগুলোর আঘাত বা ভঙ্গ করা হয়েছিল। যদিও কিছু সভ্যতা আহত, অসহায় বা নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের প্রতি সহানুভূতি দেখায়, অন্যরা নির্যাতন করে বা হত্যা করে ফেলে।’’

হেনরি ডুনান্ট যে ভয়াবহ যন্ত্রণা দেখেছিল তা তাকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে তিনি ১৮৬২ সালে ‘মেমরি অফ সলফেরিনো’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। কিন্তু তিনি যা দেখেছেন তা নিয়ে তিনি শুধু লেখেননি, তিনি একটি সমাধানও প্রস্তাব করেছিলেন। তার প্রস্তাবগুলো হচ্ছে যুদ্ধের ময়দানে আহতদের চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষণ, স্বেচ্ছাসেবী ত্রাণ গোষ্ঠী তৈরি এবং যুদ্ধের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের মানবিক সহায়তা প্রদান ইত্যাদি।

তাঁর উদ্যোগে ১৮৬৩ সালে ‘আন্তর্জাতিক রেডক্রস’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদানের কারণে ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রেদেরিক পাসির সাথে তিনি যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন।

প্রথম জেনেভা কনভেনশন

যুদ্ধক্ষেত্রে আহত, রোগাক্রান্ত সৈন্যদের জীবনের নিরাপত্তা এবং শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে প্রথম জেনেভা কনভেনশনটি ১৮৬৪ সালে অনুষ্ঠিত হয়।
 
দ্বিতীয় জেনেভা কনভেনশন

সমুদ্রস্থ যুদ্ধক্ষেত্রে আহত, রোগাক্রান্ত সৈন্যদের জীবনের নিরাপত্তা এবং শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে দ্বিতীয় জেনেভা সম্মেলনটি ১৯০৬ সালে অনুষ্ঠিত হয়।
 
তৃতীয় জেনেভা কনভেনশন

যুদ্ধবন্দীদের চিকিৎসা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে তৃতীয় জেনেভা কনভেনশন ১৯২৯ সালে অনুষ্ঠিত হয়।
 
চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন

চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন ১৯৪৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় যেখানে যুদ্ধকালীন বেসামরিক জনগণকে রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পায়।

জেনেভা কনভেনশন চুক্তি

জার্মানি ১৯২৯ সালের কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছিল কিন্তু কনভেনশনে চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধক্ষেত্রে, বাইরে, সামরিক ক্যাম্প এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেসামরিক কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মধ্যে ভয়াবহ হত্যার মত ঘটনা সংগঠিত করার সময় বাধা দেয়নি। ফলস্বরূপ, ১৯৪৯ সালে জেনেভা কনভেনশনকে আরো সম্প্রসারিত করা হয়। মূলত, যুদ্ধাহীন বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য এটি আপডেট করা হয়।

নতুন আপডেটে নিম্ম বর্ণিত ব্যক্তিদের সুরক্ষার বিধানও যুক্ত করা হয়েছিল। যেমন,

চিকিৎসা কর্মী, এবং এর সরঞ্জাম
সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আহত ও অসুস্থ নাগরিক
সামরিক যাজক
হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অস্ত্র গ্রহণকারী বেসামরিক মানুষ।

জেনেভা কনভেনশন চুক্তির প্রধান শর্তসমূহ

  • কনভেনশনের ৯ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রেড ক্রস আহত ও অসুস্থদের সাহায্য করার এবং মানবিক সহায়তা প্রদানের অধিকার রাখে। 
  • অনুচ্ছেদ ১২ এ বলা হয়েছে যে আহত এবং অসুস্থদের খুন, নির্যাতন, নির্মূল বা জৈবিক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে না।
  • জাহাজ হাসপাতাল কোন সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না বা বন্দী বা আক্রমণ করা যাবে না।
  • বন্দী ধর্মীয় নেতাদের অবিলম্বে ফিরিয়ে দিতে হবে।
  • সমস্ত পক্ষকে অবশ্যই জাহাজের ধ্বংস হওয়া কর্মীদের উদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে।
  • ১৯৪৯ সালের কনভেনশনে পুরুষ ও মহিলা বন্দীরা বিস্তৃত সুরক্ষা পেয়েছিল যেমন:
  • তাদের অবশ্যই নির্যাতন বা দুর্ব্যবহার করা উচিত নয়।
  • বন্দী হওয়ার সময় তাদের কেবল তাদের নাম, পদমর্যাদা, জন্ম তারিখ এবং ক্রমিক নম্বর দিতে হবে।
  • তাদের অবশ্যই উপযুক্ত বাসস্থান এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।
  • তাদের কোনো কারণে বৈষম্য করা উচিত নয়।
  • তাদের পরিবারের সাথে চিঠিপত্র এবং প্যাকেজ পাওয়ার অধিকার আছে।
  • রেড ক্রসের তাদের দেখার এবং তাদের জীবনযাত্রার অবস্থা পরীক্ষা করার অধিকার থাকবে।
  • আহত, অসুস্থ এবং গর্ভবতী নাগরিকদের পাশাপাশি মা এবং শিশুদের সুরক্ষার জন্য আর্টিকেলে উস্থাপন করা হয়েছিল। 
  • বেসামরিক নাগরিকদের সম্মিলিতভাবে নির্বাসিত করা বা কোনো দখলদার বাহিনীর পক্ষে বিনা বেতনে কাজ করতে যাবে না। 
  • সকল বেসামরিক নাগরিকদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করা এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনে যথাসম্ভব যেতে দেওয়া উচিত।

Do not enter any harmful link

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Do not enter any harmful link

Post a Comment (0)

নবীনতর পূর্বতন