চর্যাপদের কবিদের পরিচয়

চর্যাপদে মােট ২৪ জন পদকর্তার পরিচয় পাওয়া যায়। পদের শুরুতে, মাঝে ও শেষে ভণিতা বা কবির নামযুক্ত উক্তি ব্যবহারের কারণে এসকল কবিদের নাম জানা যায়। তবে কারও কারও গুরুর ভণিতাও আছে। চর্যাপদে কিছু পদকর্তার  নামের শেষে গৌরবসূচক ‘পা যােগ করা হয়েছে। 

চর্যার চব্বিশ জন পদকর্তা হলেন, 1. লুইপা, 2. কাহ্ন পাদ, 3. ভুসুকু পা, 4. কুকুরী পা, 5. গুণ্ডরী পা, 6. চাটিল, 7. কামলি, 8. ডােম্বী, 9. শান্তি পা, 10. মহিত্তা, 11. বীণা, 12. সরহ পা, 13. সবর পা, 14. আযদেব, 15. ঢেণ্টণ পা, 16.  দারিক, 17. ভাদে, 18. তাড়ক, 19. কঙ্কণ পা, 20. জঅনন্দি, 21. ধাম, 22. তন্ত্রী, 23. বিরুআ, ও 24. লাড়ীডােম্বী।

বৌদ্ধ সহজযানী ও বজ্রযানী আচার্যগণ সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত ছিলেন। চর্যাগীতিকার প্রায় সকল পদকর্তাই বৌদ্ধ চৌরাশি সিদ্ধার অন্তর্গত। চর্যাকারদের মধ্যে লুই, কুকুরী, বিরুআ, ডােম্বী,শবর, ধাম, জঅনন্দি ছিলেন বাঙালি। ভাষাবিচারে আরও কেউ কেউ বাঙালি হতে পারেন। তবে কয়েকজন অবাঙালিও ছিলেন।

চর্যাপদের কবিদের পরিচয়, azhar bd academy

চর্যাপদে সবচেয়ে বেশি পদ আছে কাহ্নপাদের, যা সংখ্যায় ১৩ টি। তাছাড়া ভুসুকুর আটটি, সরহের চারটি, লুই, শান্তি, শবরের দুটি করে, বাকিদের একটি করে পদ বিদ্যমান। অনেকের মতে আদি চর্যাকার লুইপা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে প্রাচীনতম চর্যাকার শবরী এবং আধুনিকতম সরহ অথবা ভুসুকপা।

চর্যাপদের প্রধান কবিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

কাহ্ন পাদ

কাহ্ন পাদ চর্যাপদের কবিগণের মধ্যে সর্বাধিক পদরচয়িতার গৌরবের অধিকারী। তার তেরটি পদ চর্যাপদ গ্রন্থে গৃহীত হয়েছে। এই সংখ্যাধিক্যের পরিপেক্ষিতে তাঁকে কবি ও সিদ্ধাচার্যদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে অভিহিত করা যায়। তিনি কানু, পা, কৃষ্ণপাদ ইত্যাদি নামেও পরিচিত। তার বিভিন্ন পদে কাহ্ন, কাহ্ন, কাহ্নূ, কাহ্নু, কাহ্ণ, কাহ্নিলা, কাহ্নিল্য প্রভৃতি ভণিতা লক্ষ করা যায়।ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, খ্রিস্টিয় অষ্টম শতকে কাহ্ন পা আবির্ভাব হয়েছিল। তার বাড়ি ছিল উড়িষ্যায়, তিনি বাস করতেন সােমপুর বিহারে। তিনি পাল আমলে দেব পালের রাজত্বকালে বর্তমান ছিলেন। 


কাহ্ন পা ৮৪০ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। তিনি বর্ণে ব্রাহ্মণ এবং ভিক্ষু ও সিদ্ধ ছিলেন। তিনি পণ্ডিত-ভিক্ষু নামে খ্যাত ছিলেন। চর্যাপদ ছাড়াও তিনি অপভ্রংশ ভাষায় দোহাকোষ রচনা করেছিলেন।  কাহ্ন পা সহজিয়া তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের যােগী ছিলেন বলে অনুমিত হয়। ড. সুকুমার সেনের মতে, কাহ্নর চর্যাগীতির রচনারীতিতে অস্পষ্টতা নাই। কয়েকটি প্রেমলীলা-রূপকমণ্ডিত চর্যাকে সেকালের প্রেমের কবিতার নিদর্শন বলে অনুমান করা যায়। কাহ্ন পা রচিত চর্যাগীতি

এবংকার দৃঢ় বাখােড় মােড়িউ।
বিবিহ বিআপক বান্ধণ তােড়িউ ॥
কাহ্ন বিলসঅ আসব মাতা ।
সহজ নলিনীবণ পইসি নিবিতা ॥
জিম জিম করিণা করিণিরে রিসঅ।
তিম তিম তথতা মঅগল বরিসঅ ॥
ছডগই সঅল সহাবে সুধ।
ভাবাভাব বলাগ ন ছুধ 
দশবর রঅণ হরিঅ দশ দিসেঁ।
বিদ্যাকরি দম জা অহিলেসেঁ

অর্থাৎ, এবংকার দৃঢ় বন্ধনস্তম্ব মথিত করে, বিবিধ ব্যাপক বন্ধন ভেঙে ফেলে আসবমত্ত কানু বিলাস করে। সে শান্ত হয়ে সহজ নলিনীবনে প্রবেশ করে। হস্তী যেমন হস্তিনীতে আসক্ত হয় তেমনি মদকল তথতা বর্ষণ করে। ষড়গতি সকল স্বভাবে শুদ্ধ। ভাবে ও অভাবে এক চুলও ক্ষুব্ধ হয় না। দশদিকে দশবল রত্ন আহরণ করে বিদ্যারূপ হস্তীকে আক্লেশে দমন কর ।

ভুসুকু পা

চর্যাগীতি রচনায় দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হলেন ভুসুকু পা। তার রচিত পদ সংখ্যা আটটি। অনেকে মনে করেন ভুসুকু নামটিকে ছদ্মনাম। তাঁর প্রকৃত নাম শান্তিদেব। তিনি সৌরাষ্ট্রের
রাজপুত্র ছিলেন এবং শেষ জীবনে নালন্দায় বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে নিঃসঙ্গভাবে অবস্থান করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ভুসুকু সপ্তম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বর্তমান ছিলেন। তিনি  ধর্মপালের রাজত্বকালে (৭৭০-৮০৬ সাল) ভুসুকু জীবিত ছিলেন। তিনি রাউত বা অশ্বারােহী সৈনিক ছিলেন, পরে ভিক্ষু ও সিদ্ধা হন।

তবে কারো কারো মতে, ভুসুকুর সময়কাল একাদশ শতকের মধ্যভাগে ছিল। ‘‘আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী। নিঅ ঘরিণী চণ্ডালে লেলী।’’ ভুসুকুর এই উক্তির মাধ্যমে তাঁকে বাঙালি বলে অনুমান করা হয়। ভুসুকু রচিত চর্যাপদ,

কাহৈরি ঘিনি মেলি অচ্ছহু কীস।
বেটিল ডাক পড়অ চৌদীস ॥
আপণা মাংসে হরিণা বৈরী।
খনহ ন ছাড়অ ভুসুকু আহেরী ॥
তিণ চ্ছুপই হরিণা পিবই ন পাণী।
হরিণা হরিণির নিলঅ ণ জানী ।
হরিণী বােলঅ সুণ হরিআ তাে।
এ বণ চ্ছাড়ী হােন্ত ভান্তো ॥
তরসঁন্তে হরিণার খুর ণ দীসঅ।
ভুসুকু ভণই মুঢ়া হিঅহি ণব পইসঈ ॥

অর্থাৎ, কাকে নিয়ে কাকে ছেড়ে কেমন করে আছি। চারপাশ ঘিরে হাঁক পড়ে। আপন মাংসের জন্যই হরিণ শত্রু। এক মুহূর্তের জন্যও শিকারি ভুসুকু ছাড়ে না। হরিণ ঘাসও ছোঁয় না, জলও পান করে না। হরিণ হরিণীর নিলয় জানা যায় না। হরিণী বলে-“হরিণ তুমি শােনাে, এ বন ছেড়ে চলে যাও। লাফ দেওয়ার জন্য হরণের খুর দেখা যায় না। ভুসুকু বলেন--এ তত্ত্ব মূঢ় ব্যক্তির হৃদয়ে প্রবেশ করে না।

লুই পা

চর্যাপদের প্রথম কবিতার লেখক লুই পাকে আদি সিদ্ধাচার্য বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাকে প্রথম বলে স্বীকার করেন না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ উল্লেখ করেছেন, তারানাথের মতে লুই বাংলাদেশের গঙ্গার ধারে বাস করতেন। তিনি প্রথম জীবনে উদ্যানের (সােয়াতের) রাজার লেখক ছিলেন। তখন তার নাম ছিল সামন্ত শুভ। 

তিনি উড়িষ্যার রাজা ও মন্ত্রীর গুরু ছিলেন। লুইপার জীবকাল মনে করা হয় ৭৩০-৮১০ সাল পর্যন্ত। তিনি সংস্কৃত ভাষায় চারটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তাঁর একটির নাম ‘অভিসময়বিভঙ্গ’। চর্যাপদের প্রথম কবিতাটি ছিল লুইপার লেখা। যেমন,

কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পইঠো কাল ॥
দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ ।
লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জাণ॥
সঅল সহিঅ কাহি করিঅই ।
সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরিঅই।
এড়ি এউ ছান্দক বান্ধ করণক পাটের আস।
সুনুপথ ভিতি লেহু রে পাস।
ভণই লুই আমহে ঝাণে দিঠা।
ধমণ চমণ বেণি পিত্তি বইঠা ॥

অর্থাৎ: শ্রেষ্ঠ তরু এই শরীর, পাঁচটি তার ডাল। চঞ্চল চিত্তে কাল প্রবেশ করে । চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ কর। লুই বলেন, গুরুকে শুধিয়ে জেনে নাও। কেন করা হয় সমস্ত সমাধি? সুখে দুঃখে সে নিশ্চিত মারা যায়। ছলবন্ধ কপট ইন্দ্রিয়ের আশা পরিত্যাগ কর। শূন্যতা পক্ষে ভিড়ে পার্শ্বে নাও। লুই বলেন, আমি ধমন চমন দুই পিড়িতে বসে ধ্যানে দেখেছি।

শবর পা

শবর পা ছিলেন বাঙালি পদকর্তা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে শবর পা ৬৮০ থেকে ৭৩২ সালে বর্তমান ছিলেন। তবে, ড. সুকুমার সেনের মতে, শবর পার জীবকাল আট শতকের প্রথমার্ধ।

কুকুরী পা

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, কুকুরী পা বাংলাদেশের লােক এবং তিনি আট শতকের প্রথমার্ধে বর্তমান ছিলেন। তিনি ৮৪০ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তার জন্মস্থান কপিলাবস্তু। তিনি ব্রাহ্মণ বংশের লোক ছিলেন।

কঙ্কণ পা

কঙ্কণ কম্বলাম্বরের বংশজ। তিনি প্রথম জীবনে বিষ্ণনগরের রাজা ছিলেন। তাঁর চর্যাপদের ভাষায় অপভ্রংশের ছাপ আছে। তার জীবৎকাল নয় শতকের শেষভাগ। 


তথ্যসূত্র
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, মাহবুবুল আলম
The Origin and Development of the Bengali language- C. Suniti Kumar

Do not enter any harmful link

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Do not enter any harmful link

Post a Comment (0)

নবীনতর পূর্বতন