আফ্রিকা মহাদেশের ১০ টি বিখ্যাত আদিবাসী সম্প্রদায়

পৃথিবীর প্রথম আদিবাসিদের বাসস্থান মনে করা হয় আফ্রিকা মহাদেশকে। এই মহাদেশে প্রাচীন সব আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাস। বর্তমান বিশ্বের আধুনিকায়নের সাথে সাথে তারা  নিজেদেরকে পরিবর্তন করেনি। আফ্রিকার ঘন জঙ্গলে অধিকাংশ আদিবাসিদের বাস। 

আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চলে এদের প্রধান বাসস্থান। প্রায় ৩ হাজার আদিবাসী সম্প্রদায় আফ্রিকা মহাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ৫৪ দেশ বিশিষ্ট এই মহাদেশে ১.৩ বিলিয়ন মানুষ বাস করে, যারা বহু ভাষা এবং উপভাষায় কথা বলে।

আফ্রিকার উপজাতি, azhar bd academy

১. পিগমি, মধ্য আফ্রিকা (Pygmy, Central Africa)

মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার বনভূমিগুলি পিগমিদের বসবাস। পিগমিরা ‍নৃগোষ্ঠিদের মধ্যে স্বতন্ত্র‌্য একটি জাতি, যারা তাদের প্রাচীন জীবনধারা এখনও বজায় রাখছে। পৃথিবীর সবচেয়ে খর্বাকার জাতি হচ্ছে পিগমি। তাদের উচ্চতা সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ হাত। 

পিগমিরা রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি, উগান্ডা, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের কঙ্গো, কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, ক্যামেরুন, বোতসোয়ানা এবং নামিবিয়ার জাতিগোষ্ঠীতেও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়াও ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ এবং নিউগিনিতে ও কিছু পিগমি বাস করে।

২. মুরসি, ইথিওপিয়া (Mursi, Ethiopia)

ইথিপিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মুরসি জাতি বাস করে। মুরসি মহিলারা অন্যন্য নৃগোষ্ঠি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মেয়েদের যৌবনের শুরুতে ঠোঁট কাটতে হয়। এটি তাদের জন্য একটি মর্যাদার বিষয়।

মুরসি ইথিওপিয়ার একটি সুরমিক নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়। ইথিওপিয়ার দক্ষিণ-পশিচমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এদের দেখা যায়। প্রায় ২ হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে মাওরিদের বসবাস। ইথিওপিয়ার বিচ্ছিন্ন এই মুরসিরা ওমো নদী এবং মাগো পাহাড়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলে দীর্ঘদিন যাবত জীবনযাপন করে আসছে। প্রায় ১০ হাজার মুরসি জনগোষ্ঠীর বাস এই উপত্যাকায়। জলবায়ুর কারনে মুরসিরা বছরে ২ বার শীত ও গ্রীষ্মে তাদের স্থান পরিবর্তন করে থাকে।

তারা জীবিকা নির্বাহ করে মূলত গবাদি পশু এবং ফসল চাষের মাধ্যমে। মুরসিরা মাতৃভাষা হিসেবে মুরসি ভাষায় কথা বলে। এই ভাষা মুলত সুরমিক ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। তাদের ধর্ম প্রকৃতি পূজা কেন্দ্রিক। প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানকে তারা পূজা করে। 

মুরসি সংস্কৃতির দুটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য যার জন্য তারা সর্বাধিক পরিচিত সেটি হচ্ছে, মহিলারা তাদের ঠোঁট কেটে তার মধ্যে একটি বড় প্লেট রাখে আর পুরুষেরা নিজেদের মধ্যে লাঠি নিয়ে খেলে। ঠোঁট কেটে ফেলা মেয়েদের জন্য সামাজিক মর্যাদার নিদর্শন । ১৫ বছর বয়সে যৌবনের প্রথম প্রদক্ষেপে পৌছালে তাদের এই কাজ করতে হয়। ঠোঁট কাটার পরের বছর গুলোতে এটির প্রসারের জন্য এর মাঝখানে কাঠের প্লাগ রাখা হয়।

ঠোঁট কেটে এর মাঝখানে ডিস্ক রাখার পেছনে কারণ রয়েছে। তবে সর্বাধিক জনপ্রিয় মতটি হচ্ছে দাস ব্যবসায়ের সময় মুরসি মহিলাদের দাস হিসাবে নিয়ে যাওয়া থেকে দাস ব্যবসায়ীদের নিরুৎসাহিত করার জন্য এটি শুরু হয়েছিল। কারণ এটি দাসের বাজারগুলিতে মুরসি মেয়েদের বিক্রির জন্য অবিবেচিত হয়েছিল এবং তাই তারা প্রায়শই বিক্রি হতে রক্ষা পেত। পুরুষেরা যৌবনের প্রথমে লাঠি লড়াই করে। এই লড়াই প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করলে সমাজে তার সম্মান এবং অগ্রাধিকার বেড়ে যায়। 

মুরসি বিবাহ

মুরসিদের বিবাহ করার আগে পুরুষদের অবশ্যই একটি পরীক্ষা দিতে হয়। একজন মুরসি লোককে একটি লাঠি দেওয়া হয় যার নাম ডোঙ্গা। দোঙ্গা লড়াই মুরসিদের বহুল প্রচলিত আনন্দ উদযাপন। অবিবাহিত পুরুষেরা শক্তি প্রদর্শন করে দোঙ্গা লড়াইয়ের মাধ্যমে। লড়াইয়ে জেতার পুরষ্কার হিসেবে একটি স্ত্রী লাভ করে। বিজয়ীকে মহিলাদের সামনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বিজয়ীকে বলা হয় মহিলাদের মধ্যে কে তাকে বিবাহের প্রস্তাব করবে।

মুরসিদের বিয়ে করার জন্য ৩৮ টি গবাদি পশু এবং একটি বন্দুক (Kalashnikov AK-47 machine gun) যৌতুক হিসেবে দিতে হয়। বন্দুকের মাধ্যমে তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধের মোকাবিলা করা হয়। মূলত গবাদি পশু চুরি, চারণভুমির আধিপাত্য, পানির অধিকার এবং একে অপরকে অপমানের প্রতিবাদে তারা এই অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে।

৩. জুলু, দক্ষিণ আফ্রিকা (Zulu, South Africa)

দক্ষিণ আফ্রিকার তথা এই মহাদেশের বৃহত্তম সংখ্যাগরিষ্ট উপজাতি হচ্ছে জুলু। প্রায় ১১ মিলিয়ন জুলু এই অঞ্চলে বাস করে। জুলুদেরকে বলা হয়ে থাকে যোদ্ধা জাতি। অধিকাংশ জুলু খ্রিষ্ট্রান ধর্মের অনুসারী, যদিও কিছু কিছু এখনও তাদের পূর্বপুরুসের উপাসনা করে থাকে। তাদের ভাষার নাম হলো ইসিজুলু যা একটি বান্টু ভাষা। ‘উমহলঙ্গা’ তাদের বাংসরিক উংসব যা ১৯৮৪ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে।

৪. কারো, ইথিওপিয়া (The Karo, Ethiopia)

দক্ষিণ ইথিওপিয়ার ওমো নদীর তীরে কারো উপজাতিদের বসবাস। জনসংখ্যা প্রায় ২ হাজারের মত। তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি রয়েছে যেটি ৫০০ বছর পর্যন্ত চলমান। ‘কারো’ জাতি তাদের দেহে রং দিয়ে আঁকার জন্য বিখ্যাত। বছরের বেশির ভাগ সময় তাদের প্রকৃতির বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়, বিশেষ করে বন্যা। সম্প্রতি সেখানে ইথিওপিয়ান সরকার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে এবং বহু লোককে হত্যা করে।

৫. হিমবা, নাবিবিয়া (The Himba, Namibia)

উত্তর-পশ্চিম নামিবিয়ার কুনেনি অঞ্চলে শিকারি প্রধান হিমবা বাস করে। হিমবা জনসংখ্যা ৫০ হাজার। এই অঞ্চলটি নামিবিয়ার একটি প্রত্যন্ত ও নির্জন স্থান। তাদের সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে ‘ওকুরুউ’ যেখানে তারা আগুন জ্বালিয়ে তাদের পূর্বপুরুষদের সাথে যোগাযোগ করে। হিমবারা চর্বি ও মাখন দিয়ে তৈরি এক ধরনের লাল রং শরীরে মাখে যা সৌন্দর্যবর্ধন এবং পোকামাকড় থেকে তাদের রক্ষা করে।

৬. মাসাই, কেনিয়া (The maasai, Kenya)

চার লক্ষ্য জনসংখ্যার মাসাই উপজাতি আফ্রিকার অন্যতম বিখ্যাত আদিবাসি। মাসাইরা কেনিয়া এবং তানজানিয়ার গ্রেট রিপ্ট ভ্যালির পাশে বাস করে। ম্যাসাই উপজাতিরা রক্তপান করে এবং তাদের সংস্কৃতিতে উদ্দ্যম নৃত্য, রঙ্গিন পোশাক পরা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

৭. সাম্বুরু, কেনিয়া (Samburu, Kenya)

উত্তর ও মধ্য কেনিয়ার সাম্বুরু অঞ্চলে বাস সাম্বুরু উপজাতি সম্প্রদায়ের। প্রায় ৩ লক্ষ্য জনগোষ্ঠী বেষ্ঠিত সাম্বুরু জাতি গবাদি পশু পালন করে জীবিকা নির্বাহ করে। সাম্বুরু তাদের অনুপম সামাজিক কাঠামো এবং রঙিন পোশাকের জন্য বিখ্যাত। সাম্বুুরু শব্দের অর্থ প্রজাপতি। সাম্বুরু নারীরা মাথা ন্যাড়া করে ফেলে এবং পোশাক হিসেবে নীল অথবা বেগুনি রংয়ের কাপড় পরিধান করে।

৮. জোসা, দক্ষিণ আফ্রিকা (xhosa, South Africa)

দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম বৃহৎ নৃগোষ্ঠী হলো জোসা।  জোসা ভাষা দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় কথ্য ভাষা। জোসা মহিলারা সাধারণত সাদা পোশাক পরিধান করে। যখন কোন জোসা যুবক বিয়ে করতে প্রস্তুত হয়, তখন তার পরিবারের মহিলার  বরের পক্ষ থেকে মেয়ের হাত চাইবে। তাদের বিয়ের আগে কনে পরিবারকে কন্যাকে লালন-পালনের জন্য কৃতজ্ঞতা স্বরুপ যৌতুক দিতে হয়।

৯. হামার, ইথিওপিয়া (Hamar, Ethiopia)

দক্ষিণ-পশ্চিম ইথিওপিয়ার ওমো উপত্যাকায় হামারদের বাস। তাদের জনসংখ্যা প্রায় ৫০ হাজারের মত। এদর বেশির ভাগ সময় চারণভুমিতে কাটাতে হয়। গ্রীষ্মে চারণভূমিতে পশুদের সাথে থাকতে হয় । যার জন্য তখন খাদ্য হিসেবে পশুর দুধ এবং রক্ত খেয়ে থাকে। তাদের পরিধানে সবসময় অলংকার থাকে। হামারদের চুলগুলো সবসময় ছোট এবং কুঁচকে তাকে।

১০. এনদেবেলে, দক্ষিণ আফ্রিকা (Ndebele, South Africa)

দক্ষিন নেদেবিল উপজাতিটি দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তর-পূর্ব প্রদেশের গৌতেং, লিম্পোপো এবং এমপুমালঙ্গায় বাস করে। তাদের রয়েছে স্বতন্ত্র‌্য সংস্কৃতি এবং বিশ্বাস, যা তাদেরকে আফ্রিকার অন্যান্য জাতি গোষ্ঠী থেকে আলাদা করে দেয়।

Do not enter any harmful link

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Do not enter any harmful link

Post a Comment (0)

নবীনতর পূর্বতন