মারমা উপজাতি : ইতিহাস ও সংস্কৃতি

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আদিবাসী মারমা। পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে বাস করে মারমা নৃগোষ্ঠী। মার্মারা নিজেদেরকে রাখাইন হিসেবে দাবি করে এবং কিছু দল নিজেদের মগ হিসাবেও ডাকে। তারা সমতল এবং পার্বত্য উভয় অঞ্চলে বসবাস করে আসছে।

মারমা কারা?

নৃতাত্তিকভাবে মারমারা মঙ্গোলীয় জাতি এবং সংস্কৃতিগতভাবে তারা মায়ানমারের রাখাইনদের কাছাকাছি। রাখাইনরদন মাথার খুলি গোলাকার, সমতল নাক, চুল কালো, সাধারণত দৈর্ঘ্যে বেটে এবং তাদের বর্ণ হালকা বাদামী। মারমা সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব থাকে রাজা ''বোহমং চি'' এবং "মং চিফ"।

বোহমং চিফ বান্দরবান এবং মং চিফ রামগড় এবং খাগড়াছড়ি জেলায় বাস করেন। মারমা সমাজ বিভিন্ন শ্রেণিতে, বা উপদলে বিভক্ত। মারমা সামাজিক জীবনে অঞ্চল প্রধান বা রাজা, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা, হেডম্যান এবং মাতবররা মর্যাদাপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকে। তাদের সমাজ সংস্কৃতিতে আদিম সমাজের অনেকগুলি মৌলিক সাদৃশ্য রয়েছে।


মারমা উপজাতি : ইতিহাস ও সংস্কৃতি, azhar bd academy

মারমাদের বাড়ি "মাচাং" নামে পরিচিত। মাচাঙ গুলোর উচ্চতা ৬ থেকে ৭ ফুট হয়। তাদের ঘরগুলি হয় চারকোণা আকৃতির। ঘরের দেয়ালগুলি বাঁশ দ্বারা এবং ঘরের ছাদ কাঁচা ঘাস দিয়ে আবৃত থাকে। প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য মাচার নিচ থেকে একটি মই সংযুক্ত থাকে।

তাদের ঘরগুলো বিভিন্ন কক্ষে বিভক্ত এবং বায়ুচলাচলের জন্য উপযুক্ত করে তৈরি করা হয়। প্রতিটি ঘর চারদিকে বেড়া দিয়ে আবৃত থাকে। মাচাঙের নীচের স্থানটি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। যেমন গবাদি পশু রাখা, জ্বালানী কাঠ সংরক্ষণ করা ইত্যাদি। মারমাদের কিছু কিছু বাড়ি মাটি দ্বারা তৈরি করে থাকে।


মারমা পেশা

কৃষি মারমাদের প্রধান পেশা হিসেবে স্বীকৃত। ঝুম চাষ হচ্ছে তাদের প্রাথমিক কৃষিকাজ।  মারমাদের জীবিকা নির্বাহ মূলত ঝুম চাষ এর মাধ্যমে করে থাকে। এই জুম চাষের জন্য তারা প্রথমে পাহাড়ের  বন পরিষ্কার করে। খড় সমূহকে শুকিয়ে পরে জমি চাষের আগে পুড়িয়ে দেয়। এটি তাদের খাদ্য এবং জীবিকা নির্বাহের মূল উৎস।


তারা পাহাড়ি বন থেকে গাছের পাতা এবং শিকড় সংগ্রহ করে। কাপড় বুনা মারমা মহিলাদের একটি সাধারণ কাজ। তারা আগে বাজারমুখী অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের  জন্য প্রস্তুত ছিল না। ঝুম উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় তারা এখন ফল ও সবজি চাষ করছে এবং পোল্ট্রি পালন ও কুটির শিল্প করছে। তবে মারমাদের মূল পেশা হল কৃষিকাজ। এগুলি ছাড়াও তারা কাপড় বুনা, লবণ সংগ্রহ এবং গুড় তৈরি করে থাকে। কৃষিকাজে পুরুষ ও মহিলা উভয়ই অংশগ্রহণ করে। মারমা মহিলারা বিশেষ করে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালন করে।

মারমা ভাষা

মারমাদের নিজস্ব উপভাষা রয়েছে, যা বার্মিজ এবং আরাকানদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে শহরাঞ্চলে এবং নিকটবর্তী এলাকাতে মারমারা চট্টোগ্রামের স্থানীয় ভাষায় কথা বলতে দেখা যায়। তাদের সংখ্যা, দিন, মাস এবং বছরগুলির নাম বার্মিজ ও আরাকানীদের মতো।


মারমা ধর্ম

মারমারা থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী। পালি ভাষায় রচিত ত্রিপিটক হল মারমাদের পবিত্র গ্রন্থ। ধর্মীয় বিষয়ে তারা দুটি দলে বিভক্ত। একটি সন্ন্যাসী সম্প্রদায় এবং অপরটি লাইটি। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা ব্রহ্মচর্য বজায় রেখে হলুদ রঙের পোশাক পরে এবং মন্দিরে থাকে। অন্য অংশ স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়স্বজনদের সাথে পারিবারিক জীবনযাপন করে।


মারমা সমপ্রদায়ের লোকেরা বিশ্বাস করেন যে, তাদের জন্ম, মৃত্যু, পুনর্জন্ম এবং জীবনের সমস্ত কার্যকলাপ একটি অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রভাবে ঘটে থাকে। তাদের মধ্যে অনেকে প্রকৃতি পূজা করে। তাছাড়াও তারা অন্ধবিশ্বাস, যাদু এবং অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রতি বিশ্বাস রাখে।

মারমা বিবাহ

বিবাহ হচ্ছে মারমা সমাজে একটি  ধর্মীয় এবং সামাজিক গুরুত্বপূর্ন অংশ। সাধারণত অভিভাবকরা বিবাহের ব্যবস্থা করে থাকে, তবে মারমা সমাজে প্রেমের বিবাহও স্বীকৃত রয়েছে। তারা বহু বিবাহ এবং বিধবা বিবাহ করতে পারে। বাল্য বিবাহ ও যৌতুক বিনিময় মারমা সমাজেে নিষিদ্ধ। পুরুষ ও মহিলা উভয়েরই বিবাহ বিচ্ছেদের সমান অধিকার রয়েছে। তাদের মধ্যে যৌতুক বিনিময় করা নিষিদ্ধ।

মারমা খাবার

মারমাদের প্রধান খাদ্য হল কাঁচা মরিচ এবং লবণ মিশ্রিত সিদ্ধ চাল এবং শাকসবজি।মারমারা দিনে দু'বার খাবার গ্রহণ করে। খাওয়ার পরে চা পান করা তাদের একটি সাধারণ অভ্যাস। মারমা পুরুষরা অবসর সময়ে মদ পান এবং তাস খেলে। তারা পাইপের সাহায্যে ধূমপান করে। তাদের খাদ্য তালিকায় চাল, মাছ, ডাল এবং শাকসব্জী রয়েছে। এছাড়াও শুয়োরের মাংস এবং শুকনো মাছ তাদের প্রিয় খাবার।


মারমা সম্প্রদায়ের তিন স্তরের একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা থাকে । গ্রাম পর্যায়ের প্রশাসনের নেতৃত্বে থাকে একজন কারবারি। মৌজা স্তরের নেতৃত্বে থাকে হেডম্যান এবং সার্কেল বা আঞ্চলিক স্তরের নেতৃত্বে থাকে অঞ্চল প্রধান বা রাজা। পাহাড়ি জুম করের দায়িত্বে থাকে  হেডম্যান এবং রাজা। এছাড়াও এই তিন স্তরের প্রত্যেকে জগড়া-বিবাদ প্রশমন এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক দায়িত্ব পালন করে।

মারমা প্রধান উৎসব

মারমাদের উৎসব সাগ্রায় নামে পরিচিত। মারমারা পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করতে সাংগ্রাই উৎসব পালন করে। তারা পহেলা বৈশাখের দিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করে। নানা ধরনের মুখরোচক খাবারের আয়োজন করে মারমা সমপ্রদায়। 

পহেলা বৈশাখে নতুন নতুন পোশাক পরে একে অন্যের বাড়িতে যায় এবং কুশল বিনিময় করে। সেদিন নারীপুরুষ সম্মিলিতভাবে নাচ আর গানে মেতে উঠে। মারমাদের এ দিনের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে জলকেলি অনুষ্ঠান বা পানি খেলা। মারমা ভাষায় জল অনুষ্ঠানকে বলা হয় রিলংপোয়ে।

বাড়ির আঙিনায় আগে থেকে পানি খেলার জন্য প্যান্ডেল তৈরি করা থাকে। মারমা যুবকরা বাদ্য আর গানের তালে তালে এসে উপস্থিত হয় অনুষ্ঠানস্থলে। সেখানে ফুলে ফুলে সজ্জিত প্যান্ডেলের ভিতরে পানি নিয়ে অপেক্ষায় থাকে তরুণীরা। যুবক যুবতীরা একে অপরের প্রতি জল ছিটানো থাকে। তারা পানিকে পবিত্রতার প্রতীক ধরে। মারমা মেয়েরা পানি ছড়িয়ে নিজেদেরকে শুদ্ধ করে নেয়।

Do not enter any harmful link

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Do not enter any harmful link

Post a Comment (0)

নবীনতর পূর্বতন