বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের ইতিহাস

স্থানীয় সরকারের ইতিহাস

বাংলাদেশের বর্তমান স্থানীয় সরকার নানা সময়ে বিবর্তন, পরিবর্তন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। প্রাচীন বাংলা থেকে শুরু করে আধুনিক যুগে প্রবেশে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আজকের আলোচনায় একদম প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাংলাদেশের স্থানীয় পরিষদের বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে আলোকপাত করব।

প্রাচীন বাংলার স্থানীয় সরকার

একদম প্রাচীনকালে স্থানীয় পরিষদ ছিল ২ প্রকার। হেডম্যান (Headman), এবং পনছায়েতত (Panchayets)। হেডম্যান ছিল সমাজের সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্বকারী পরিষদ। এই হেডম্যান সরাসরি কেন্দ্র বা রাজ্য প্রধান থেকে নিয়োগ পেত।

স্থানীয় পরিষদ এবং কেন্দ্রের মধ্যে সমন্বয়ের কাজ করত হেডম্যান। মূলতত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে স্থানীয়ভাবে ট্যাক্স বা কর সংগ্রহ করা তার দায়িত্ব ছিল। দ্বিতীয়ত,পনছায়েত ছিল গ্রামের একটি সিনিয়র কাউন্সিল যারা সরকারী উচ্চপদস্ত লোকদের সাথে যোগাযোগের ভূমিকা পালন করত।  

বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের ইতিহাস, azhar bd academy


তবে প্রাচীনকালে উত্তর ভারতে চার ধরনের পনচায়েত বিদ্যামান ছিল। তারমধ্যে, 
1. Caste Panchaets
2. Village Panchaets
3. Single purpose panchayets
4. Panchayets for resolving disputes

মধ্যযুগে স্থানীয় সরকার

মধ্যযুগের শুরুতে সুলতানাত শাসনে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ইউনিট, ইকলিম, এরশা, শাহা, এবং কাসবা এই পাঁচ স্তরে বিভক্ত ছিল। ইউনিটের প্রধান ছিল শাসক। ইকলিমের প্রধান ছিল উজির এবং এরশার প্রধান ছিল শের-ই-লসকর। এছাড়া মুগল শাসনে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ছিল ইউনিট, সুবা, সরকার/ছাকলা, পরগনা, এবং থানায়। মুগল শাসনে ইউনিট প্রধান ছিল শাসক। সুবার প্রধান সুবেদার বা নাজিম। ছাকলা প্রধান ফজদার। পরগনার দায়িত্বে থাকত শিকদার এবং থানার দায়িত্বে থানাদার। 

ব্রিটিশ শাসনে স্থানীয় সরকার

১৭৫৭ সালে ব্রিটিশদের উপমহাদেশ শাসন ব্যবস্থা ছিল তাদের নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লবের পর ব্রিটিশ সরকার স্থানীয় সরকারের প্রয়োজনবোধ করে। এরজন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮৭০ সালে গ্রাম্য চকিদারি অ্যাক্ট পাস করে। মূলত এই আইনের মাধ্যমে পুরনো পনছায়েত ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। পনছায়েতের প্রধান কাজ ছিল গ্রামে প্রহরী বা চকিদার নিয়োগ যারা সরকারের আদেশ উপদেশ রক্ষণাবেক্ষন করে। স্থানীয়ভাবে কর আদায়ের দায়িত্ব পালন করত পনছায়েত।

১৮৮২ সালে লর্ড রিপন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার জন্য একটি রেজুলেশন তৈরি করেন। ফলাফল হিসেবে ১৮৮৫ সালে বেঙ্গল কাউন্সিল Bengal Local Self Government আইন পাশ করে। আইনের কার্যকারীতা হিসেবে সারা বাংলা প্রদেশ ১৬ টি জেলায় ভাগ হয়ে যায়।  বর্ধমান, রাজশাহী, ঢাকা, পাবনা নিয়ে প্রদেশের বিভাগ গঠিত হয়। এর মাধ্যমে স্থানীয় সরকার তিনটি স্তরে বিভক্ত হয়। 


১. জেলা বোর্ড (District Board): প্রত্যেক জেলার জন্য একটি জেলা বোর্ড। জেলার আকার ও আয়তন অনুসারে জেলা বোর্ড ১৮-৩৪ সদস্য নিয়ে গঠিত হত। প্রত্যেক সদস্য কেন্দ্রীয়ভাবে ৫ বছরের জন্য নিয়োগ করা হত। জেলার ম্যাজিস্ট্রেট জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করত। জেলার সার্বিক উন্নয়ের দায়িত্ব থাকত জেলা বোর্ডের উপর।

২. স্থানীয় বোর্ড (Local Board): লোকাল বোর্ড উপজেলার জন্য। সর্বনিম্ম ৬ সদস্য নিয়ে স্থানীয় বোর্ড গঠন করা হয় যারমধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য জনগনের সরাসরি ভোটে নিযুক্ত ছিল। এছাড়া এক-তৃতীয়াংশ সদস্য সরাসরি সরকার কর্তৃক নিয়োগ করা হত।

৩. ইউনিয়ন কমিটি (Union Committee): গ্রামের নির্দিষ্ট শ্রেণীর সমষ্টি নিয়ে গঠিত হয় এই ইউনিয়ন কমিটি। প্রতিটি ইউনিয়ন কমিটির আয়তন ছিল ১২ বর্গমাইল এলাকা। সর্বনিম্ম ৫ সদস্য এবং সর্বোচ্চ ৯ সদস্য নিয়ে এই কমিটি গঠিত হয়, যারা স্থানীয় জনগনের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত।

১৯১৯ সালে আরো একটি স্থানীয় সেল্প গভর্মেন্ট আইন পাস করে ব্রিটিশ সরকার। এর মাধ্যমে আগের চকিদারি পনছায়েত ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে নতুন ইউনিয়ন বোর্ড গঠিত হয়। বাকি লোকাল এবং জেলা বোর্ড এই আইনে কোন পরিবর্তন আনা হয়নি।

পাকিস্তানি আমলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা

১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্তি হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান নামে ছিল। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে। তিনি স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাসিক ডেমোক্রেসি নামে একটি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেন। ১৯৫৯ সালে The Basic Democracy Order পাস করেন তিনি। এর মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায় থেকে শহর পর্যায়ে শাসন প্রণালী গৃহিত হয়। 

ইউনিয়ন কাউন্সিল, থানা কাউন্সিল, জেলা কাউন্সিল এবং বিভাগীয় কাউন্সিল নামে চার স্তরের শাসন কাঠামো গঠন করে। এছাড়া ১৯৬০ সালে পৌরশাসন সক্রান্ত একটি প্রশাসনিক অর্ডিনান্স আইন জারি করে আইয়ুব খানের সামরিক সরকার। এর ফলে পৌর বা শহর এলাকায় টাউন কমিটি এবং ইউনিয়ন কমিটি নামে দু স্তর বিশিষ্ট পরিষদ থাকবে।

বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের বিবর্তন

১. শেখ মুজিবের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা (১৯৭২-৭৫)

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান President Order No. 7 ঘোষণা করে। এই ঘোষণার মাধ্যমে পূর্বের ইউনিয়ন কাউন্সিল পরিবর্তন হয়ে নতুন নাম হয় ইউনিয়ন পনছায়েতে। থানা কাউন্সিল থেকে থানা ডেভেলপমেন্ট এবং জেলা কাউন্সিল থেকে পরিবর্তন হয়ে জেলা বোর্ড নামকরণ হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের স্থানীয় সরকার কাঠামো এটি ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। 

১৯৭৩ সালে President Order No. 22 ঘোষণার মাধ্যমে ইউনিয়ন পনছায়েতের নতুন নাম হয় ইউনিয়ন পরিষদ। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সর্বনিম্ম স্তর ছিল ইউনিয়ন পরিষদ। প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদ তিনটি ওয়াডে বিভক্ত ছিল। প্রথ্যেক ইউনিয়ন পরিষদ একজন চেয়ারম্যান, একজন ভাইস চেয়ারম্যান এবং ৯ জন মেম্বার নিয়ে গঠিত হয়। ইউনিয়ন পরিষদের মেয়াদ কাল ছিল নির্বাচন সময় থেকে পরবর্তী ৫ বছর। 

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে বড় ধরনের এক রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধিত হয়। শেখ মুজিব সংবিধানের ৪র্থ সংশোধন এনে বাকশাল নামের একক রাজনৈতিক দল গঠন করে। সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন কর। এই পরিবর্তন  স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায়ও লক্ষ্য করা যায়। তখন সকল ধরনের স্থানীয় সরকার কাঠামো বাতিল করে প্রত্যেক জেলার জন্য শুধুমাত্র এডমিনিস্ট্রিটিভ কাউন্সিল নামে একটি ব্যবস্থা চালু করে। 

২. জিয়াউর রহমানের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা (১৯৭৬-৮১)

১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা লাভের পর একটি অর্ডিনান্স জারি করে। ঘোষণা অনুযায়ী তিন ধরেণের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা তৈরি করেন। এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ, থানা পরিষদ, এবং জেলা পরিষদ নিয়ে স্থানীয় সরকার গঠিত হয়। পরিবর্তনের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদ বিলুপ্ত করেন তিনি। বাকি সব কিছু আগের মতই বিদ্যামান ছিল। প্রত্যেক জেলার জন্য একটি জেলা পরিষদ এবং থানার জন্য থানা পরিষদ ছিল।

৩. এরশাদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা (১৯৮২-৯১)

সেনা প্রধান জেনারেল এরশাদ ১৯৮২ সালে দেশে সামরিক আইন জারি করে। ১৯৮২ সালে তিনি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন আদেশ জারি করেন। থানা পরিষদকে পরিবর্তন করে নতুন দেন উপজেলা হিসেবে। তার৭র সময়ে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ছিল ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পল্লী পরিষদ, এবং পার্বত্র জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ নামে।

১৯৮৯ সালে পার্বত্য তিন জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি এবং বান্দরবান নিয়ে পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার গঠিত হয়। প্রত্যেক জেলায় একজন চেয়ারম্যান এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক সদস্য উপজাতি এবং অ-উপজাতি নিয়ে গঠিত হয়। পরিষদের মেয়াদকাল হবে ৩ বছর। জেলার ডিসি উক্ত পরিষদের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।

৪. খালেদা জিয়ার স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা (১৯৯১-৯৫)

১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া স্থানীয় সরকারের কয়েকটি পরিবর্তন এনে অর্ডিনান্স জারি করেন। ১৯৯৩ সালের স্থানীয় সরকার সংশোধন আইন অনুসারে ইউনিয়ন পরিষদ এবং থানা উন্নয়ন সমন্বয়ক কমিটি  নামে নতুন স্থা্নীয় সরকার কাঠামো গঠিত হয়। আইন মোতাবেক, প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদ নয়টি ওয়ার্ডে বিভক্ত হয়। পরিষদে মহিলাদের জন্য তিনটি সিট সংরক্ষিত থাকবে। থানা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি একজন চেয়ারম্যান, পদাদিকার সদস্য,  মনোনীত সদস্য, এবং সরকারী করমকর্তা নিয়ে গঠিত।

৬. শেখ হাসিনার স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা (১৯৯৬-২০০১)
৭. খালেদা জিয়ার স্থানীয় সরকার (২০০১-২০০৬)
৮. শেখ হাসিনা

Do not enter any harmful link

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Do not enter any harmful link

Post a Comment (0)

নবীনতর পূর্বতন